ফাদার পিশোতো : একজন মহান মানুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণ

‘৯৪ সালের কোনো এক সকালের কথা। মিরপুর চৌদ্দ নম্বর থেকে টেম্পু-বাস-টেম্পু করে ভোর আটটার ক্লাস ধরার চেষ্টা করছি। ট্রাফিক জ্যামের জন্য কলেজে পৌঁছতে আটটা বেজে পাঁচ মিনিট হয়ে গেলো। তিনতলা ভবনের নিচের তলায় দেখলাম রাশভারী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ কড়াভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, “কোন গ্রুপ”? আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, “গ্রুপ ২”। তিনি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন, “তিন তলার ওই পাশে চলে যাও, করিডরের শেষ ক্লাস”। আমি হন্তদন্ত হয়ে গ্রুপ ২-এর ক্লাসরুমের দরজায় কড়া নারলাম। একটু পরে দীর্ঘদেহী শেতাঙ্গ একজন মানুষ খুব বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বললেন, “পিছে যাও”। আমি কিছু না বুঝে হাবার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি ক্লাসের প্রায় দেড়শ ছাত্র আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, সেই সাথে কয়েকজন পেছনে দাঁড়িয়ে। তিনি আবারো বললেন, “পিছে যাও”। ঘটনা বুঝতে বাকি রইলো না। মাথা নিচু করে চলে গেলাম একদম পেছনে এবং দাঁড়িয়ে ক্লাস করলাম পরবর্তী প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট। আমার কলেজ জীবনের প্রথম সেই শিক্ষকই ফাদার জোসেফ স্টিফেন পিশোতো, আর নিচতলার সেই রাশভারি মানুষটার নাম টেরেন্স পিনেরো।

দুই জনের কেউই আজ আমাদের মাঝে নেই। টেরেন্স পিনেরো পরলোকগত হয়েছেন অনেক বছর আগে, আর ফাদার পিশোতো চলে গেলেন সম্প্রতি। আমার আজকের স্মৃতিচারণ ফাদার পিশোতোকে নিয়ে।

ফাদার পিশোতো আমাদের পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। আমরা ’৯৪-এর এসএসসি ব্যাচ। মানে হচ্ছে ৫০০ প্রশ্ন ব্যাংকের সেই কালো সময়ের মানুষ। আমাদের মাধ্যমিকের সাধারণ বিজ্ঞান প্রথম পর্বের ছোট একটি বই উচ্চ-মাধ্যমিকে হয়ে গেলো বড় বড় চারটি বইয়ে, যার মধ্যে পদার্থ আর রসায়নের দুইটি করে খণ্ড। নটর ডেম কলেজে আমরা পড়তে এসেছি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মোটামুটি সবাই খুব ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছি মাধ্যমিকে। আশেপাশের মানুষ ভালো ছাত্র বলে জানে, কিছুটা সমীহও করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা কলেজের পড়াশুনার চাপে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস, এর মধ্যে তিন দিন ল্যাব।

যেদিন ল্যাব থাকে সেদিন কলেজ শেষ হতে বাজে বিকেল পাঁচটা। যে-সময় অন্য কলেজের বন্ধুরা বেইলি রোডে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে-সময় আমরা পদার্থবিদ্যা ল্যাবে হয়তো তাপবিদ্যার বিদঘুটে সব এক্সপেরিমেন্ট মেলাচ্ছি। একটু পান থেকে চুন খসলেই ল্যাব ব্রাদাররা রিপোর্ট ছিড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন। এরকম অবস্থায় বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা আসাটা অকল্পনীয়। কিন্তু সেই বৈরিতার মধ্যে ফাদার পিশোতোর ভাঙা ভাঙা বাংলায় ভেক্টর আর গতিবিদ্যার লেকচার শুরু হলো। প্রথম দিকে বিরক্ত লাগতো, এতো সব কী বলে! সরাসরি পদার্থবিদ্যার ডিরাইভেশন আর অংক করালেই তো হয়! এ দুটো পারলেই তো লেটার মার্কস নিশ্চিত।


ফাদার পিশোতো আমাদের শুরু করলেন ভেক্টর পড়ানো দিয়ে। ভেক্টর তো আমরা বুঝি। ইক্যুয়েশন আছে, সমাধান করে দিলেই তো হয়। না, তিনি আমাদের বোঝাতে লাগলেন গল্প দিয়ে। তার সেই ভাঙা ভাঙা বাংলাতে শুরু করলেন কাল্পনিক এক ফাঁকিবাজ ছাত্রের গল্প। সেই ছাত্র একদিন বুড়িগঙার পারে গিয়ে এক নৌকার মাঝিকে বলছে তাকে নদী পার করে দিতে। তো, মাঝি নৌকা আড়াআড়িভাবে না চালিয়ে স্রোত যেদিক থেকে আসছে সেই দিকে নৌকা চালানো শুরু করল। আর যায় কোথায়, সেই ফাঁকিবাজ ছাত্র মাঝিকে ঝাড়ি মারা শুরু করল কেন সে নৌকা সরাসরি ওই পাড়ের দিকে না চালিয়ে কোনাকুনিভাবে চালাচ্ছে। মাঝি তাকে যতোই বোঝায় যে, এইভাবেই নদী পার হতে হয় সে ততই ঝাড়ি মারে। অবশেষ মাঝি নিরুপায় হয়ে নৌকা সোজাসুজিই চালানো শুরু করে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো! স্রোতের টানে নৌকা ওই পাড়ে যেখানে যাবার কথা, তার থেকে অনেক দূরে চলে গেল। অগত্যা সেই ছাত্র বাস মিস করল, তার কলেজে আসতে দেরি হলো। কলেজে পৌঁছেই দেরি হবার কারণে সে ঝাড়ি খেল টেরেন্স পিনেরোর কাছে, তার পরে দৌড়িয়ে ক্লাসে এসে সে পদার্থবিদ্যার স্যারকে ব্যাখ্যা করলো কেন তার দেরি হয়েছে। স্যারের আর বুঝতে বাঁকি রইলো না যে, সেই ছাত্র পদার্থবিদ্যার ক্লাসে ভেক্টর পড়ানোর সময় ফাঁকি মেরেছে!

আমরা মুগ্ধ হয়ে তার এই গল্পগুলো শুনতাম। আর ভাবতাম, কই বইতে তো এই কথাগুলো নেই। বইয়ে তো ইক্যুয়েশন বসিয়ে আমরা কোন এঙ্গেলে নৌকা চালালে ওই পাড়ে যাওয়া যাবে সেটির সমাধান আছে। কিন্তু সেই সমাধানে তো কোনো আনন্দ নেই, যা এই গল্পগুলোতে রয়েছে!

ভেক্টর নিয়ে ফাদার পিশোতো আরো গল্প শোনাতেন। সেই যে একজন পাহাডের গায়ে দাড়িয়ে বৃষ্টির কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাচ্ছে, কিন্তু সে মাথার উপরে সোজাসুজি না ধরে কেন বাঁকা করে ধরছে। ভেক্টর শেষ হয়ে শুরু হলো গতিবিদ্যা। ততোদিনে আমরা ফাদাদের সাধাসিধে জীবনযাপন দেখে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। সাদা শার্ট পড়েন, সেই সাথে গ্যাবাডিনের প্যান্ট। সেই প্যান্টে অসংখ্য ছেঁড়া অংশ, আর সেলাই দিয়ে সেই ছেঁড়া অংশগুলো জোড়া লাগানো। ক্লাস শেষ করেই চলে যান প্রিন্সিপালের অফিসে। একদিকে পুরোদমে পদার্থবিদ্যা পড়ানো আর সেই সাথে পুরো কলেজের দ্বায়িত্ব। এর মাঝে ছাত্রদের পিতামাতার সাথে ফলাফল নিয়ে আলোচনায় বসেন। যখনই দেখি, ফাদার পিশোতো ছুটছেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে।

গতিবিদ্যা শুরু হওয়াতে আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সহজ সব ইক্যুয়েশন প্রমাণ করা আর সেই সাথে সমস্যার সমাধান করা। আমরা তখন শেখা শুরু করেছে u গতিবেগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে a ত্বরণে t সময় পরে গতিবেগ কত হবে, কত দূরে যাবে ইত্যাদি। সেইসময় একটি ইক্যুয়েশন ছিলো u গতিবেগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে a ত্বরণে t সময় চললে t-তম সেকেন্ডে একটি বস্তু কতদূর যাবে। তো, এটিতো আমাদের জন্য সহজ, এটার জন্য t-তম সেকেন্ডে দূরত্বের ইক্যুয়েশন আছে সেটি বসিয়ে দিলেই হয়। না, ফাদার পিশোতো আমাদের বইয়ের সেই ইক্যুয়েশন ব্যবহার করতে দিবেন না। তিনি ছবি একে বোঝাতে লাগলেন আসলে t-তম সেকেন্ডে দূরত্ব জিনিসটা কী? সরাসরি ওইটার জন্য বানানো ইক্যুয়েশন না ব্যবহার করে তিনি (t-1) সেকেন্ডে মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব আর t সেকেন্ডে মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব বের করে সেখান থেকে জিনিসটা বুঝিয়ে সমাধান করতে লাগলেন। প্রথম দিকে কী যে বিরক্ত লাগত এই ঝামেলার জন্য, কিন্তু পরবর্তীতে যখন প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে গেলাম আর প্রথম সেমিস্টারেই হাতে আসলো স্থিতিবিদ্যা আর গতিবিদ্যা, ফাদার পিশোতোর সেই মুখটা খুব মনে পড়তো।

ফাদার পিশোতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছিলেন প্রকৌশলবিদ্যায়। যুক্তরাষ্ট্রের খুব বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিদ্যায় ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশের একটি কলেজে উচ্চ-মাধ্যমিকের ছাত্রদের পরম মায়ার আর ভালোবাসায় তিনি পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। সেই ভালোবাসার বৃত্ত থেকে বের হয়ে এসে পরবর্তী জীবনে এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে এসেছ মাথা। তাঁর অনাড়ম্বর জীবন দেখে কী শিখতে পেরেছি জানি না, কিন্তু জীবনের খুব কঠিন সময়ে কলেজের সেই দেবদারু গাছগুলার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দীর্ঘকায় এই মানুষটির কথা ভেবে ভরসা পেতাম এই ভেবে যে, জীবন অনেক বড়, সেখানে হারা মানা সাজে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর ফাদারের সাথে একবার দেখা হয়েছিলো। কিন্তু এর পরে আর দেখা হয়নি ফাদারের সাথে। ১৯৯৮ সালেই অবসর নিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল হিসেবে। বিদেশে আসার পরে দেশে যতোবার গিয়েছি, সময়ের অভাবে আর দেখা হয়নি। শেষ যখন খবর পেলাম ফাদারের করোনা হয়েছে, চিন্তায় পড়েছিলাম। করোনা থেকে সেরে উঠলেও এ পৃথিবী থেকে ঠিকই বিদায় নিলেন এই মহান পুরুষ।

শেষ করছি আমার লেখক বন্ধু দ্রোহীর (লেখক নাম) একটা উক্তি দিয়ে: “এই মানুষটা সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কারো কাছে খারাপ কথা শুনিনি”। যেখানেই থাকুন ফাদার পিশোতো, ভাল থাকুন। এই পৃথিবীতে আপনার অবদান অনেক, আপনার তুলনায় আমরা অনেক অনেক স্বার্থপর!

লেখকঃ ড. জাহিদুল ইসলাম- নটরডেমিয়ান ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। বর্তমানে পানি বিজ্ঞাণী হিসেবে কর্মরত আছেন কানাডাতে।