এডমন্টনে নাট্যচর্চা

আমার নাট্যচর্চা শুরু শৈশবে, টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী স্কুল ও নজরুল সেনার মাধ্যমে। এর পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুয়েট ড্রামা সোসাইটির সাথে যুক্ত থাকার সময়ে বেশ কিছু মঞ্চনাটকে অভিনয় করা হয়েছে। নাট্যচর্চা বিষয়ে সরাসরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী প্রয়াত এস এম মহসিন ও আজাদ আবুল কালাম মহোদয়ের কাছ থেকে। এডমন্টনে আমি আসলাম ২০০৭ এর জানুয়ারীতে। প্রায় তুষারে ঢাকা এই শহরটাতে এসে মনটা প্রথমে অসম্ভব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যে শহরটাকে ট্রাফিক জ্যামের শহর বলে গালি দিতাম, কেন জানি সেই শহরটাকে বড্ড বেশি মনে পড়া শুরু করল। আস্তে আস্তে সময় গড়াল, একটু একটু করে এখানকার বাঙালী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেয়া শুরু হলো। সেই সম্পৃক্ততার সুত্র ধরেই এডমন্টনে নাট্যচর্চার সাথে আমার যাত্রা শুরু। সেই যাত্রার আলোকেই এই লেখা।

এডমন্টনে নাট্যচর্চা মূলত দুটি সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকেঃ বাংলাদেশ কানাডা এসোশিয়েশন অফ এডমন্টন বা বিসিএই, এবং বাংলাদেশি স্টূডেন্ট এসোশিয়েশন অফ ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা বা বাসুয়া। এখানে মঞ্চনাটকের সূচনা হয় ২০০৮ সালে। শৈলেন গুহের লেখা ও রাফাত আলমের নির্দেশনায় প্রথম বারের মত মঞ্চায়িত হয় হাস্যরসময় নাটক "ফাঁস"। নাটকটি ব্যাপক সাড়া জাগায় এখানকার দর্শকদের মধ্যে। নাটকটি এডমন্টনে দুই বার এবং ক্যালগেরীতে ২০০৯ এর বাংলা উৎসবে প্রদর্শিত হয়। নাটকের গল্পটি শুরু হয় একটি গোয়েন্দা অফিসকে কেন্দ্র করে। গোয়েন্দাদের প্রধান ডি.এস.পি. ঘরে স্ত্রীর শাসনে আর অফিসে অধস্তনদের বোকামী কর্মকান্ডে অস্থির। নিজের ছেলেও পড়াশুনা বাদ দিয়ে বিপথে যাবার উপক্রম। ঠিক সেই মুহূর্তে এস.পি.র কাছ থেকে নির্দেশ আসে দুটি গুরুত্বপূর্ন কেস তদন্ত করার জন্যঃ একটি হলো চিত্রনায়ক নবীন কুমারের বাসা থেকে কালো টাকা উদ্ধার করা আর অপরটি সোনালী রায় নামের এক মহিলা চোরাকারবারীরকে আটক করা। এবারও যথারীতি গোয়েন্দারা বোকামীর পরিচয় দিতে থাকে। একদিকে কেসের দূরাবস্থা, অন্যদিকে ছেলের লাপাত্যা হওয়া এবং তা নিয়ে স্ত্রীর সাথে বাকবিতন্ডাতে বিপর্যস্ত ডি.এস.পি. নিজের ডিমোশন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা। শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনার আবর্তে গোয়েন্দারা দুজনকেই ধরে আনতে সক্ষম হয়, কিন্তু নায়কের ফ্যানদের কর্মকান্ড, নিজের স্ত্রীর ছেলেমানুষী, মহিলা চোরাকারবারীর সাথে এক গোয়েন্দার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক, এবং নিজের ছেলের আসামী হিসেবে ধরা পড়ার ঘটনায় ডি.এস.পি. নিজের গলাতেই ফাঁস অনুভব করেন।


২০১০ সালে আমার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় ১৯৭৪ এর দূর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে মমতাজউদ্দিন আহমেদের লেখা নাটক "হরিণ চিতা চিল"। অভিনয়ে হাতেখড়ি অনেক আগে হলেও এই নাটকটির মধ্য দিয়ে আমার নির্দেশনার হাতেখড়ি। আর তাই নাটকটি নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস, ভাললাগা, দুশ্চিন্তা, আবেগ সবই কাজ করেছে তীব্রভাবে। নাটকে বর্নিত 'হরিণ চিতা চিল' আসলে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন যারা সমাজের উন্নয়নে কাজ করে থাকে। এই সংগঠনের কর্নধার হরিণ খ্যাত হাজেরা একজন সুযোগসন্ধানী সমাজকর্মী মহিলা, আর তার সহযোগী দুই যুবক হাকিম আর ভুইঞা (চিতা আর চিল)। হাজেরা এই দুই যুবককে মায়ার জালে আচ্ছন্ন করে রাখে কাজ হাসিলের জন্য, সুতরাং বলাই বাহুল্য এই দুই যুবক হাজেরার প্রতি দূর্বল। 'দেশের গরুরা ঠিকমতন দুধ দিচ্ছেনা' এই অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে তারা সভা ডেকেছে! সভাপতি হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে মুখোশধারী একজন সমাজপতি হাক্কানীকে। সভাতে বক্তব্য রাখছেন নারীনেত্রী, কবি, বিশেষজ্ঞ, জননেতা ইত্যাদি নানা রকমের মানুষ। মজার বিষয় হচ্ছে বক্তারা কেউ আসল সমস্যা নিয়ে কথা বলছেননা, সবাই যার যার স্বার্থ আর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি সভাপতি হাক্কানীও ঘুরে ফিরে হাজেরার প্রতি তার দূর্বলতা প্রকাশ করছেন আর হাজেরাও তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারন সাফল্যের অনেক উপরে উঠতে হাজেরার প্রয়োজন একটি সিড়ি। হাক্কানীর দেয়া একটি গাই গরুর দুধ থেকে ছানা ফাটিয়ে শুরু হয় হরিণ চিতা চিলের রসগোল্লার ব্যবসা। হাকিম আর ভুইঞা পার্কে বসে রসগোল্লা বিক্রি শুরু করে। সাধারণ মানুষ যেখানে খেতে পারছেনা, ক্ষুধার জ্বালায় ঢাকার রাস্তায় সবুক্তিগীন আর তার মা হন্নে হয়ে খুঁজছে লঙ্গরখানা সেখানে হরিণ চিতা চিলের সখের দোকান ১৯৭৩ এর সময়কালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে নাট্যকারের নিরব বিদ্রোহকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন রকমের মানুষের রসগোল্লার দোকান দেখে আর তাদের কথা বার্তায় '৭৩ সালের নানা রকম অসংগতিগুলো চোখে পড়ে। দেশের উন্নয়নের নামে যে ব্যবসা সেখানে ক্ষুধার জ্বালায় কাতর ছোট্ট একটি ছেলে সবুক্তিগীন বার বার চেয়েও একটি রসগোল্লা পায়না, খাদ্যের সন্ধানে সবুক্তিগীন একসময় হারিয়ে যায় মানুষের ভীরে, কে জানে হয়ত সে লাঠিয়ালের হাতে মার খেতে হারিয়ে যায় চিরতরে, কিংবা না খেতে পেরে একসময় শিয়াল ককুরের মুখের গ্রাস হয়। একদিকে ক্ষুধার জ্বালা আর অন্যদিকে পুত্রকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে পাগলের মত ঘুরে বেড়ানো সবুক্তিগীনের মার ভাগ্যেও যুটে যায় লঙ্গরখানার লাঠিয়ালের হাতের মার আর হাকিমদের গলাধাক্কা। উদ্ভ্রান্তের মত ঘুড়ে বেড়ানো মানুষের বিবেকরূপী পাগলের কথায় চোখ খুলে যায় ভুইঞার, সে বিপ্লবী হয়ে উঠে, বিদ্রোহ ঘোষনা করে এই সমাজ আর মুখোশ পড়া হাজেরা হাক্কানী আর হাকিমদের বিরুদ্ধে। হাজেরা সব বুঝতে পারে কিন্তু ততক্ষনে ভুইঞাদের দিয়ে তার স্বার্থ হাসিল শেষ, ততক্ষণে সে হাক্কানীকে পেয়ে গেছে সমাজের উঁচু তলার পৌছানোর বাহন হিসেবে। এভাবেই উপড়ে উঠে যায় স্বার্থপরেরা। হাজেরা হরিণ প্রজাপতির ডানা মেলে, পেছনে পড়ে থাকে সবুক্তিগীনের লাশ অন্ধকারে শেয়াল কুকুরের মুখের গ্রাস হয়ে। শোষিত আর ক্ষুধিতের আর্তনাদ বাতাসে ভর করে হাক্কানী হাজেরা আর হাকিমদের উচুতলায় পৌঁছায়না কখনো তবে সবুক্তিগীনের মৃত্যুক্ষুধা মাঝে মাঝে ভুইঞাদের মনে জন্ম দেয় বিল্পবের। নাটকটি বেশ দর্শক সমাদৃত হয়।


২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উপরোক্ত দুটি সংগঠনের মাধ্যমেই বেশ অনেকগুলো ছোট ছোট নাটক ও যাত্রা মঞ্চায়িত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে নাটক "আরতি", এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অবসানের আহবান নিয়ে নাটক "জমেছে খেলা সারা বেলা"। জার্জিস আহমেদের লেখা 'জমছে খেলা সারাবেলা' নাটকটি একুশে ফেব্রুয়ারী ২০১০ উপলক্ষ্যে আমরা ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টাতে মঞ্চস্থ করি। প্রবাসে নাট্যকর্মী আর অনুশীলনের সময়ের স্বল্পতার কারনে মোরশেদুর রহমান রিপনের নির্দেশনায় মূল নাটকটির একটি সংক্ষেপিত রূপ মঞ্চস্থ হয়। নাটকটির কাহিনী আবর্তিত হয় বাংলাদেশের ছোট্ট একটি শহর (কল্পিত) সুবর্নসরা কে কেন্দ্র করে। কোন এক একুশে ফেব্রুয়ারীর সকালে সুবর্নসরার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবাই অপেক্ষা করছে শহীদদের স্মরনে শ্রদ্ধাঞ্জলী দেয়ার জন্য। সেখানে প্রবেশ করে ক্ষমতাশীল দলের প্রতিনিধি মবিল, চারদিকে স্লোগানে স্লোগানে ধ্বনিত হয়। মবিল জনগণকে আশ্বস্ত করে যে তাদের নেতা এখন আসছে, নেতার আসতে দেরী হয়েছে কারন জনগণের চিন্তায় নেতার রাতে ভাল ঘুম হয় নাই। তারপরেও শুধু একুশে ফেব্রুয়ারীর জন্যই নেতা তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে আসছেন। ঐদিকে মঞ্চে একই সময়ে প্রবেশ করে অপর রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ডিজেল এবং একই ভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করে যে তার নেতা ব্যাক্তিগত কাজে ব্যস্ত কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনারে আসবেন। বাংলাদেশের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী এই দুই দলের প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে বাকবিতন্ডে লিপ্ত হয় কে আগে ফুল দিবে তা নিয়ে। সেই সুযোগে মঞ্চে প্রবেশ করে বাংলাদেশের স্বার্থান্বেষী, সুবিধাবাদী মৌলবাদী দলের প্রতিনিধি। স্যাণ্ডেল পড়ে মিনারে প্রবেশ করে বলে দুই দলের প্রতিনিধির কাছে যে ঝাড়ি খায় শুরুতে কিন্তু আস্তে আস্তে সে একদলকে বুঝাতে পারে যে সে (মৌলবাদী) থাকলে সাপোর্ট পাবে, আরা রাজনীতির মাঠে সুবিধা উঠাতে (মৌলবাদী) তাকে তাদের দরকার। সাধারন জনগণের প্রতিনিধি সোহেল রাজনীতি বুঝেনা, সে বুঝে একুশ। সোহেল একুশের সকালে খালি পায়ে হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আস্তে আস্তে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গান গাইতে গাইতে মিনারে প্রবেশ করে। সোহেলের এই প্রবেশ ডিজেল আর মবিলের চোখ এড়িয়ে গেলেও এড়ায়না মৌলবাদী গোষ্ঠীর। অবশেষ টনক নড়ে ডিজেল আর মবিলেরও। তারা তাকে ফুল দিতে বাঁধা দেয় কারন তাদের দুইজনের নেতাইত এখনো ফুল দেয় নাই। রাজনৈতিক দলের এই অন্যায় যুক্তি সোহেলকে প্রতিবাদী করে তুলে, সেই সাথে শহীদ মিনারের বেদীতে যুদ্ধাপরাধীদের পদচারণা তার রক্তকে টগবগে করে দেয়। মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হুজুরকে সে মনে করিয়ে দেয় যে ইতিহাস মুছে ফেলা যাবেনা, বাংলার মাটিতে একদিন তাদের বিচার হবে। এতে হুজুরের ভয় হয়না বরং সে উপহাসের হাসি দিয়ে মনে করিয়ে দেয় যে বিচারের কথা বলে লাভ নেই দরকার হলে নতুন করে অপরাধী বানানো হবে। সোহেল ডিজেল আর মবিলের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কিভাবে তাদের প্রশ্রয়ে এই ধর্মব্যবসায়ী আজ কত উদ্ধত হয়ে কথা বলছে, সে চেষ্টা করে একাত্তরে এদের বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে ডিজেল আর মবিলের চোখ খুলে দিতে। এই পর্যায়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মানসে হুজুর সোহেলকে হত্যা করে। সোহেলের মৃত্যু ডিজেল আর মবিলের মনে বিস্ময় আর ভয় নিয়ে আসে কিন্তু হুজুরের আসল স্বরূপ তাতে উদ্ঘাটিত হয়। তার মনে হয় এই ছাপোষা মানুষ না মেরে যদি এই মিনারটাকেই সে ধ্বংস করে দিতে পারতো। প্রতিবাদী মানুষের মৃত্যু যেমন হয়না, তেমনি সোহেলের আত্মা হয়ে উঠে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, আর বাংলা ত্রিশ লক্ষ শহীদদের প্রতিনিধি। সে ডিজেল মবিলদেরকে চলে যেতে বলে এই শহীদ মিনারে বেদী থেকে কারন এই মিনার কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের, এই মিনার বাংলার নবজাগরনের সূচনাস্থান। সোহেলের প্রতিবাদী কন্ঠে পালিয়ে যায় শোষকের দল আর মাঝাখানে সম্মিলিত মানুষের প্রতিরোধের মতই সোহেলের বজ্জ্রমুঠি হাত উঁচু হয়ে থাকে।


ছবি ১- এডমন্টন পাবলিক লাইব্ররির স্ট্যানলি মিনিলার থিয়েটার হলে “ফাঁস” নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন, ২০০৮ সালে

ছবি ২- এডমন্টন এর শেরউড পার্কে “হরিণ চিতা চিল” নাটকের মঞ্চায়ন, ২০১০ সালে

ছবি ৩- এডমন্টন এর প্লিজেন্ট ভিউ কমিউনিটি হলে “জমেছে খেলা সারা বেলা” নাটকের মঞ্চায়ন, ২০১০ সালে

সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে নাটক "আরতি" মঞ্চস্থ হয় ২০১০ সালের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। নাটকটির ঘটনা আবর্তিত হয় দুই বখাটে যুবককে কেন্দ্র করে যারা আসলে সমাজের নেতাদের হাতের পুতুল। কোন এক পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় জীবনের কাছে পরাজিত এই দুইজন যুবক মদ্যপানে মত্ত হয়ে তাদের ভেতরের পুঞ্জীভুত বেদনার কথা মনে করতে। ঝাপসা চোখে তারা দেখে তাদেরই বর্বরতার শিকার “আরতি” নামের সেই মেয়েটিকে। হঠাৎ করে তাদের ভাল করে বাঁচার খুব সাধ হয়। ভোরের লাল আভায় তারা দেখে আরতিকে, ঘাসের শিশির ছুঁয়ে তারা দেখে আরতিকে, কাশবন-গোধূলি বিকেল-ঘাসফড়িং সব জায়গায় তারা দেখে আরতিকে। তারা প্রতিজ্ঞা করে আরতিকে ভালবাসায় বাঁচিয়ে রাখতে।


২০১৬ সালে আমার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের কালজয়ী নাটক "বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ"। নাটকটি আবারো তুমুল ভাবে দর্শক সমাদৃত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের অসংগতি কে তুলে ধরেছেন বহুবারই। এমনি এক সৃষ্টির নাম “বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ”। মধুসূদন দত্ত সেই রক্ষণশীল সমাজকে উদ্দেশ্য করে এই নাটকটি লিখেছেন যারা বাহিরে সাধুর বেশ ধরে থাকেন কিন্তু অন্তরে লুকিয়ে থাকে কপটতা, ভন্ডামী। তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন এই প্রহসনমূলক রচনায়। নাটকটির প্রহসনের আবহ পুরোপুরি দেশজ। যশোর-খুলনা-চব্বিশ পরগণা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের ফলে তা যথেষ্ট অর্থপূর্ণ হয়েছে।


২০১৭ সালে আমরা প্রথম বারের মত এখানে বেড়ে উঠা শিশু-কিশোরদের জন্য মঞ্চনাটকের উদ্যোগ নেই। আমার লেখা ও নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় নাটক “আমাদের বিজয়”। নাটকটির উদ্দেশ্য ছিল মূলত নাটকের মাধ্যমে শিশুদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুব সংক্ষেপে শেখানো। প্রথমেই যে সমস্যার মুখোমুখি হলাম সেটা হচ্ছে স্ক্রিপ্টের। সাধারণত বাংলাদেশে নাটকের যেসব স্ক্রিপ্ট পাওয়া যায় তাতে অনেক ডায়ালগ থাকে যা এখানে বেড়ে উঠা বাংলাদেশি শিশুদের জন্য আয়ত্তে আনা অনেক কঠিন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেই ‘আমাদের স্বাধীনতা’ নামে শিশুদের জন্য একটি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখলাম। স্ক্রিপ্ট লেখার সময় লক্ষ্য ছিল যেন প্রত্যেকটা শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রীর কিছু না কিছু ডায়ালগ থাকে, আর সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক বিষয়গুলো যেন নাটকে স্থান পান (যেমন, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার গল্প, পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসরদের অত্যাচার, মুক্তিবাহিনী, এবং সবশেষে বিজয়ের আনন্দ)। প্রথমে নাটকের ডায়ালগগুলো শিশুদের আত্মস্থ করতে সমস্যা হলেও দেখা গেল কয়েক সপ্তাহের মহড়ার পর ওরা দারুণ ভাবে ডায়ালগ গুলো বাংলায় বলছে। নাটকের মহড়ার সময় আমার নির্দেশনা ছিল সবাই যেন নিজদের সাথে বাংলাতে কথা বলে। নাটকটি আমরা এডমন্টনে দুই বার মঞ্চস্থ করলাম এবং যাতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে আমাদের এই ক্ষুদে অভিনয়শিল্পীরা, এবং সেটা পুরোটাই বাংলাতে। নাটকটি এখানকার দর্শক ও অভিভাবকদের মাঝে দারুন ভাবে সাড়া ফেলে। নাটকটি ২০১৮ সালেও আরেকবার মঞ্চস্থ হয়।

ছবি ৪- এডমন্টন এর ডাগন কমিউনিটি হলে “আরতি” নাটকের মঞ্চায়ন, ২০১০ সালে

ছবি ৫- এডমন্টন এর বনিডুন হলে “বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ” নাটকের মঞ্চায়ন, ২০১৬ সালে

ছবি ৬- এডমন্টন এর বনিডুন হলে “আমাদের বিজয়” নাটকের মঞ্চায়ন, ২০১৭ সালে

২০১৯ সালে আমাদের সংগঠন বিসিএই এর চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে আমার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা নাটক “ভাড়াটে চাই”। নাটকটিতে প্রায় ত্রিশ জন নাট্যকর্মী কাজ করে। নাটকটি এডমন্টনে দুই বার মঞ্চায়িত হয় এবং দর্শকনন্দিত হয়। নাট্যকার শ্রী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত হাসির নাটক “ভাড়াটে চাই” এর গল্প আবর্তিত হয় বাড়িওয়ালা ভূপেন তলাপাত্রকে কেন্দ্র করে। তার ভাইপো গাবলু খবরের কাগজে ভাড়াটে চেয়ে বিজ্ঞাপণ দিয়েছে। বিজ্ঞাপণ যখন ছেপেছে ভাড়াটে তো আসবেই। কিন্তু ঘর ভাড়া দিতে গিয়ে ভূপেন বাবু নানা রকমের বিপত্তির সম্মুখীন হন। সেই সাথে ঘটতে থাকে মজার সব কাহিনী যা নিয়েই এই দম বন্ধ করা হাসির নাটক “ভাড়াটে চাই”।

২০২০ সালে প্যানডেমিক শুরুর ঠিক আগে আমরার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় নির্বাক গীতিনাট্য “ধর্ম যার যার দেশ সবার”। গীতিনাট্যটির মূল ধারনা পেয়েছিলাম বাংলাদেশ রোভার স্কাউটের একটি ইউটিউব ভিডিও থেকে।কিছুটা ভিন্ন ধাচের এই গীতিনাট্যটিতে আবারো ধর্ম নিয়ে সম্প্রীতির আহবান জানানো হয়। হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার স্বাক্ষী বাংলাদেশ শুধু তার অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্যই বিখ্যাত ছিলনা, বাংলার মানুষদের অকৃত্রিম ভাত্ত্ববোধ আর সম্প্রীতির বন্ধন ছিল সবসময়ই অটুট। কিন্তু যুগে যুগে উপনিবেশিক শক্তি আমাদের ভাতৃত্বের বন্ধনকে করেছে ছিন্ন, সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আমাদের করেছে আচ্ছন্ন। শুধু তাই নয়, ভীনদেশি শাসকেরা আঘাত হেনেছে আমাদের ভাষা আর সার্বভৌমত্বের উপর। তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য সাম্প্রদায়িকরার বিষ ঢেলে আমাদেরকে বিদ্ধ করেছে বার বার। সেরকমই এক সময়, যখন পরাধীনতার শেকলে আমরা বন্দী, বাংলাদেশের ছোট্ট একটি গ্রামে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সেই ঘটনা নিয়েই মঞ্চস্থ হয় নির্বাক গীতিনাট্য “ধর্ম যার যার, দেশ সবার”


প্যান্ডেমিক এর জন্য ২০২০ সালে আমরা মঞ্চনাটক করার সুযোগ পাইনি। তবে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে মুনীর চৌধুরীর “কবর” নাটকটি ভিডিও নাটক হিসেবে আমরা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রচারিত করি। নাটকটিতে আমি অভিনয় করি ও নির্দেশনা দেই। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা নাটক "কবর"। শহীদ মুনীর চৌধুরী রাজবন্দী হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্ধী অবস্থায় এই নাটকটি লিখেন। ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথম শহীদ দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে নাটকটি জেলখানায় সর্বপ্রথম মঞ্চস্থ হয়। ভাষা আন্দোলনে বহু মানুষ শহীদ হলেও অল্প ক'জনের পরিচয় আমরা জানতে পেরেছিলাম; কত শত লাশ গুম করা হয়েছিল, তার প্রকৃত হিসাব আজও জানা যায়নি। লাশ গুমের এই ঘৃণ্য রাজনীতিকে উপজীব্য করেই নাটকটির পুরো গল্প এগিয়ে গেছে। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর দিকে সরাসরি আঙুল তুলে এমন একটি নাটক লেখাটা সত্যিই অনবদ্য নিদর্শন।


ছবি ৭- এডমন্টন এর গেটওয়ে এলাইন্স চার্চ হলে “ভাড়াটে চাই” নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন, ২০১৯ সালে

ছবি ৮- এডমন্টন এর সেজং মালটি-কালচারাল সেন্টারে “ধর্ম যার যার দেশ সবার” নির্বাক গীতিনাট্যের মঞ্চায়ন, ২০২০ সালে

ছবি ৯- কোভিড প্যান্ডেমিক এর মধ্যে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে নির্মিত “কবর” নাটকের সেট ও কিছু অংশবিশেষ। নাটকটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনলাইন স্ট্রিমিং এর মাধ্যমে প্রচারিত হয়।

এই লেখাটিতে এডমন্টনে সফলভাবে মঞ্চস্থ কিছু নাটকের গল্প শোনালাম পাঠকদের। এডমন্টনে নাটচর্চার ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হচ্ছে এখানে অনেক নাট্যকর্মী আছেন যাদের নাটকে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও আগ্রহ রয়েছে। সেই সাথে এডমন্টনে নাট্যচর্চার পরিবেশও খুব ভাল। যেহেতু এখানে অধিকাংশ নাটকই বিসিএই এর প্রযোজনায় হয় সেই দিক থেকে আমরা বেশ সৌভাগ্যবান যে আমাদের নাট্যচর্চার পেছনে আয়োজক হিসেবে বিসিএই কে সবসময় পাশে পাওয়া যায়। এডমন্টনে মঞ্চনাটকের দর্শক আসলে ব্যাপক, আমাদের সবগুলি নাটকই আসলে হলভর্তি দর্শক সমাগমের মাধ্যমে মঞ্চায়িত হয়েছে। যেহেতু এখানে নাটক খুব কম হয় (বছরে একটি বা দুটি) তাই নাটকের দর্শকদের মধ্যে আগ্রহও অনেক বেশি। নাটক নিয়ে আমার ব্যাক্তিগত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা স্বপ্ন হচ্ছে একদিন এখানে শুধু নাটকের জন্যই দর্শক অনুষ্ঠান দেখতে আসবে। এখন যেটা হয় আরো অনেক কিছুর সাথে নাটক একটি পরিবেশনা হিসেবে থাকে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা নাটকের জন্য বিশেষ মঞ্চ আসলে সেইভাবে পাইনা। আমি আসলে সেইদিনের অপেক্ষায় যেদিন এখানে শুধু নাটকের জন্যই বিশেষ অনুষ্ঠান হবে।


ড. জাহিদুল ইসলাম একজন পানি বিজ্ঞানী ও সংস্কৃতিকর্মী।


বিদ্রঃ লেখাটি বাংলাদেশ কানাডা এসোশিয়েশন অফ এডমন্টনের বার্ষিক প্রকাশনা এডমন্টন বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছে।